ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা তাঁর সহোদর। গ্রামে লোকেরাও তাই বলে। দেখলে মনে হবে তিনি যেন রবী ঠাকুরেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তিনি একজন অভিনেতা, সাধক, কবি ও বাউল। নাম তাঁর পন্ডিত শ্রী খরগোমোহন রায়।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর তিনি দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার কাচিনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা পালান চন্দ্র রায় ওরফে ঠাকুর দাস ছিলেন একজন সাধক ও কৃষক। দুই ভাই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন তিনি। জন্মের পর থেকে তার জীবন কেটেছে হাসি ও আনন্দে। যার চিহ্নটুকু শেষ বয়সেও ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।
শিশু বয়সেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখে বাবা তাকে স্থানীয় গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ওই স্কুলের শিক্ষক পন্ডিত সুরেন্দ্র নাথ রায়, পন্ডিত কিরিট ভূষণ রায় এবং পন্ডিত দীনবন্ধু নাথ রায় ছিলেন তৎকালীন যাত্রাপালা অভিনেতা ও পরিচালক। গুরুজনদের সহযোগিতায় অসাধারণ প্রতিভাধর বালকটি যুক্ত হয় যাত্রাপালার সাথে। লেখাপড়ার পাশাপাশি মনোনিবেশ করেন যাত্রাভিনয়ে।
অভিনয় করলেও কৃতিত্বের সহিত প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং উচ্চ শিক্ষার লাভে ভর্তি হন তৎকালীন দিনাজপুর মহকুমার মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে বীরগঞ্জের রহিম বকস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পাশের দু’বছরের মাথায় ভূষিরবন্দর নিম্ন বিদ্যালয়ে সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দু’বছর শিক্ষকতা করার পর রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানেও তিনি দু’বছর শিক্ষকতা করে বদলী হয়ে আসেন তাঁর শিক্ষা জীবনের প্রথম স্কুল গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে দীর্ঘ ৩১ বছর শিক্ষকতা জীবন অতিবাহিত করে অবসর নেন। এ সময় শিক্ষকতার পাশাপাশি পুরোপুরি জড়িয়ে পরেন যাত্রাভিনয়ে।
তিনি একাধারে অভিনেতা, যাত্রার মাস্টার, সুরকার, গায়ক, গীতিকার, কবি, পুরোহিত ও সাধক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ২৫টি বেশি যাত্রায় অভিনয়, পরিচালনা ও যাত্রাগানের সুর করে ব্যাপক আলোচিত হন। তাঁর অভিনীত যাত্রার মধ্যে- শোণিত উৎসব’, আত্মাহুতি, পণমুক্তি, হারানো মানিক, একটি পয়সা, রিক্সাওয়ালা, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও দস্যু মোহন উল্লেখযোগ্য। তিনি বেশির ভাগ সময় বালক-বালিকা কখনো কমেডি ও দস্যুর চরিত্রে অভিনয় করেন।
যাত্রাভিনয়ের সহকর্মীদের মধ্যে, শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র রায় প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান, কমলা কান্ত, কেশব চন্দ্র, ধরনী কামত্ম, মৃত সুরজ, মৃত গজেন্দ্র নাথ, মৃত জমির উদ্দিন শাহ ছিলেন তার একান্ত সঙ্গী। তাঁরা একসাথে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রাভিনয় করে হাজার হাজার দর্শকের মন যুগিয়েছেন।
শিক্ষকতা ও অভিনয়ের সাথে সাথে ধর্মীয় এবং সাহিত্য চর্চাতেও তিনি সিদ্ধহসত্ম। নানান প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও কৃষ্ণভক্ত অশীতিপর এই সাধক মানুষটি প্রাচীন ও অর্বাচীন মিলে সহস্রাধিক অমূল্য বইপুসত্মক তাঁর সংগ্রহে রেখেছেন। এবং তা নিয়মিত অধ্যয়ন করেন। সবচেয়ে আশ্চার্যের ব্যাপার হলো সত্তরোর্ধ এই প্রবীণ সাধক চশমা ছাড়াই খালি চোখে পড়াশোনা ও চলাফেরা করতে পারেন।
তিনি মূল সংস্কৃত (দেবনাগিরি) ও বাংলা ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ পদাবলীর চারটি এবং বাউল সংগীতে একটি পুস্তক রচনা করেন (রচনাগুলো অপ্রকাশিত)। যার মধ্যে রয়েছে- নৌকা বিলাস, মাথুর, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম লীলা, মানভঞ্জন। এছাড়াও তিনি শতাধিক বাউল সংগীত রচনা করেন।
জীবন চলার পথে দেখায় ভারত ও বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থান ও মহান ব্যক্তি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাধক ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরম্নল ইসলামের সাথে।
সংসার জীবনেও তিনি একজন আদর্শ স্বামী এবং পিতা হিসেবে রেখেছেন অমূল্য স্বাক্ষর। ৩ ছেলে ও ৬ মেয়ের মধ্যে সকলেই শিক্ষিত। তার বড় ছেলে অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক হিসাব কর্মকর্তা, মেঝ ছেলে এম.বি.বি.এস ডাক্তার এবং ছোট ছেলে সিকিউরিটি কোম্পানীতে চাকুরীরত।
কর্মব্যস্ত ও কর্তব্যপরায়ণ বহুবিধ জ্ঞানের অধিকারী পন্ডিত শ্রী খরগোমোহন রায় স্ত্রী বেলা রানীর কাছে অকল্পনীয় সহযোগিতা পেছেন। দীর্ঘ জীবনে শিক্ষকতা ও অভিনয় পেশা থেকে অবসর নিয়ে এখন তাঁর সময় কাটে ধর্মীয় সাধন, উপাসনা, কীর্ত্তন ও বাউল সংগীতের মাঝে। বর্তমানে সাধক জীবনেও পেয়েছেন ৫ শতাধিক শিষ্য ও ভক্তানুরাগী। তবে বার্ধক্যজনিত কারণে গত কয়েক দিন ধরে তিনি অসুস্থতায় ভুগছেন। তাঁর সুস্থতায় এলাকার সকলে দোয়া প্রার্থী।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস